সবার আগে সুস্থতা

স্বাস্থ্যবিধি ও পরামর্শ,

সবার আগে সুস্থতা
 রাজিব আহমেদ ....


কখনো কি ভেবে দেখেছেন- সুস্থতা আমাদের জীবনের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার? ধরা যাক, আপনি খ্যাতি, যশ, প্রতিপত্তি, সম্পদ সবকিছুরই অধিপতি, কিন্তু শরীর যদি সুস্থ না থাকে, আপনি কি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন? সুস্থ না থাকলে জীবনকে কি উপভোগ করা যায়? এজন্যই বলা হয়ে থাকে ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ; সকল সুখের মূল’। সবকিছু থাকার পরও আপনি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন বেঁচে থাকাটাই উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। আপনার মনে যদি প্রাণবন্ততা না থাকে, যদি সব সময় দুশ্চিন্তায় ভোগেন, উদ্বিগ্ন থাকেন, তাহলে তো বাকি সবকিছুই অর্থহীন।
হযরত মুসা (আ.)-এর একটি ঘটনা থেকেও আমরা সুস্থতার গুরুত্ব বুঝতে পারব। মুসা নবী একবার স্রষ্টার কাছে জানতে চাইলেন, মানব সন্তানের তার স্রষ্টার কাছে সবার আগে কী চাওয়া উচিত? স্রষ্টার জবাব ছিল, শারীরিক সুস্থতা। নিঃসন্দেহে সুস্থতা স্রষ্টার সবচেয়ে বড় নেয়ামত, কিন্তু মুশকিল হলো- নিজে অসুস্থ না হওয়ার আগে পর্যন্ত কেউ সেটা ঠিকভাবে উপলব্ধিই করেন না! 

প্রশ্ন হলো আমরা অসুস্থ হই কেন? গবেষকরা বলছেন, শতকরা ১০% রোগের কারণ বংশগত। আপনার বাবা-মা বা রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় যে সকল রোগে আক্রান্ত ছিলেন বা হয়েছেন, আপনার সে সকল রোগ হওয়ার আশংকা একটু বেশিই, তবে সেটা নিয়তি বা ভাগ্য- যেখানে আপনার কোনো হাত নেই। কিন্তু বাকি ৯০% রোগের কারণ উল্টাপাল্টা খাদ্যাভ্যাস। অধিকাংশ মানুষ তার খাবারের ব্যাপারে মোটেই সচেতন নয়। আমরা যেখানে যা পাই, তাই খাই। মুখে মজা লাগলে তো আর কথাই নেই, উদরপূর্তি না হওয়া পর্যন্ত গোগ্রাসে গিলতে থাকি। কোনটা শরীরের প্রয়োজন আর কোনটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর- অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষেরও সেদিকে কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলতে থাকলে শরীরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। শরীর যদি তার দরকারি পুষ্টি না পায়, পক্ষান্তরে নিয়মিত ক্ষতিকর খাবার শরীরে ঢুকতে থাকে, এক পর্যায়ে শরীর এমনভাবে বিগড়ে যায় যে তাকে পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা মুশকিল!

শরীরটাকে ‘মাগনা’ পেয়েছেন বলে অযত্ন করবেন না। আমাদের কিন্তু খাদ্যের অভাব নেই; অভাব খাদ্য-জ্ঞানের। শরীরকে সুস্থ রাখতে প্রচুর পানি ও ফলমূল খান। যে ফল দেখতে মানবদেহের যে অঙ্গের মতো সেই ফল শরীরের সেই অঙ্গের হেফাজতকারী। পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশে পানীয় আর বাকি এক-তৃতীয়াংশ শূন্য রাখার অভ্যাস করুন। সকালে খান রাজার মতো, দুপুরে প্রজার মতো আর রাতে দীনহীনের মতো খান। নিচে আরো কিছু আদর্শ বৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাস তুলে ধরা হলো-

* প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারই বৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাস। দৈনন্দিন খাবার তালিকায় মাছ ও মাংসের পরিমাণ সীমিত, ডাল পরিমিত এবং শাক-সবজি পর্যাপ্ত খান। বাঁধাকপি, ডাটা লালশাক, পুঁইশাক, সজনে ও আঁশ জাতীয় সবজি বেশি থাকা উচিত। শাক-সবজি অতিরিক্ত সিদ্ধ না করে আধা সিদ্ধ করে খান।

* প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় থেকে দুই লিটার বা ছয় থেকে আট গ্লাস পানি পান করুন। পানীয় হিসেবে ডাব খেতে পারেন। ডাব না পেলে লেবুর পানি খান। 

* প্রতিদিন সালাদ খান। সালাদে লেটুস, টমেটো, গাজর, শসা, ক্যাপসিকাম, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, লাল বাঁধাকপি ব্যবহার করুন। শীতকালে নিয়মিত পালংশাক, ব্রোকোলি ও গাজর খান।

* মৌসুমি ফল পর্যাপ্ত খান। আম, কাঁঠাল, আনারস, চালতা, জাম্বুরা, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, বেল, জাম, জামরুল, শরিফা, কলা, লিচু, আমড়া, কামরাঙ্গা ও আমলকি অর্থাৎ দেশি ফল খান। মৌসুমী ফল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

* প্রতিদিন খাবারে ডাল রাখুন। মসুরি ডাল, মুগ, মাষ, বুট, মটর, অড়হর ডাল একসঙ্গে মিশিয়ে রান্না করুন।

* পুষ্টির জন্য নিয়মিত এক গ্লাস দুধ ও একটি ডিম খান। চিনি ছাড়া টক দই খেতে পারেন।

* প্রতিদিন সকালে পানিতে ভেজানো এক মুঠো কাঁচা ছোলা, এক টুকরো আদা, কালোজিরা ও মধু খাওয়ার অভ্যাস করুন।

* নিয়মিত সব ধরনের বাদাম খাওয়ার অভ্যাস করুন।

* চা খেলে শুধু হালকা লিকার বা গুড় চা/সবুজ চা খান; দুধ-চা খাবেন না।

* সপ্তাহে দুই দিন শুধু নিরামিষ খান; মাংস মাসে চার দিনে সীমিত রাখতে সচেষ্ট থাকুন।

* টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার, মিষ্টি, বিশেষত রং দেওয়া মিষ্টি এবং টেস্টিং সল্টযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ বর্জন করুন।

* রেস্তোরাঁ ও বাইরের খাবার যত কম খাওয়া যায় তত ভালো।

* তামাক, সিগারেট, মদ, মাদক অর্থাৎ সব ধরনের নেশাকারক দ্রব্য পুরোপুরি বর্জন করুন।

* সবচেয়ে জরুরি কথা- মুখে যে খাবারটি বেশি মজা লাগে, সেটি কম করে খান!
৬০% রোগের কারণ মনোদৈহিক
যেসব কারণে মানুষ ডাক্তারের কাছে যায়, তার ৬০% কারণ হলো মনের জট, যা কোনো ওষুধ দিয়ে সারানো সম্ভব নয়। আসলে সুখের অভাবই হলো অসুখ। মনে সুখের অভাব হলে তার প্রভাব পড়ে দেহে। মনের দুঃখ, কষ্ট, ক্ষোভ, হতাশা, গ্লানি জমে তা শরীরে বিষ-ব্যাথা-বেদনা আকারে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। মাথাব্যাথা, মাইগ্রেন, ব্যাকপেইন, বাতব্যাথা, হৃদরোগ ও এ্যাজমার মতো ক্রনিক রোগের কারণও তাই। মনটাকে যদি প্রশান্ত রাখতে পারি, সব সময় প্রফুল্ল থাকতে পারি, আনন্দে সময় কাটাতে পারি, তাহলেই সুস্থভাবে জীবন কাটানো সম্ভব। কতদিন বাঁচবেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বাঁচার মতো বাঁচাটাই আসল। ওজন দিয়ে স্বাস্থ্যের বিচার করবেন না; কর্মক্ষমতা দিয়ে স্বাস্থ্য পরিমাপ করুন।
সবাই সুস্থ, সুন্দর জীবন চান। যদি না পান, সেটা আপনার নিজের দোষ। শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও আত্মিক দিক দিয়ে ভালো থাকার নামই সুস্থতা। জীবনদৃষ্টি যখন সঠিক হয়, জীবনের কষ্টগুলো তখন আনন্দে রূপ নেয়। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিই পরিপূর্ণ জীবন আর বাদবাকি বিষয়গুলো জীবনের অংশ, যদিও অধিকাংশ মানুষ পরিপূর্ণ জীবনকে উপেক্ষা করে খন্ডিত জীবনটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়! আমরা তখনি শরীরের যত্ন নিতে আরম্ভ করি, যখন শরীর আর যত্ন আশা করে না। বাকি জীবন কাটে হতাশা, গ্লানি আর দুশ্চিন্তায়। জানেন নিশ্চয়- পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় টেনশন নিরাময়ের ওষুধ!
মনে যে দুশ্চিন্তা ঢুকে বাসা বেঁধে ফেলে, সে-ই শরীরে সংক্রামিত হয়ে নানা রোগের জন্ম দেয়। অনুগ্রহ করে দুশ্চিন্তাকে সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে বেড়াবেন না। মনকে সুস্থির করুন। অসুস্থ বিনোদন থেকে দূরে থাকুন। নইলে বিনোদিত না হয়ে বরং টেনশন বাড়বে। মনের জট খুলে ফেলুন। দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, জীবন বদলে যাবে। নিজেকে বদলাতে না পারলে অন্য কেউ এসে সেটা করে দেবে না।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা অল্পতেই রেগে যাই, দুশ্চিন্তা ছাড়া একটি দিনও কি আমরা কাটাতে পারছি? একটু খতিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন- মন খারাপের কারণ অতীত, দুশ্চিন্তার কারণ ভবিষ্যৎ। তারচেয়ে বরং বর্তমানে থাকুন; আনন্দে বাঁচুন। মনের নেতিবাচক চিন্তা দূর করুন। মনের জট খুলতে না পারলে শরীর কখনো সুস্থ থাকবে না। জট না খুললে সুতা যেমন ব্যবহারের অযোগ্য, মনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মনের জট খুললেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এভাবে আমাদের অজান্তে আমাদের অনেক রোগের কারণ আমরা নিজেরাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে- সেই রোগগুলো থেকে সহজেই মুক্তি লাভ করা সম্ভব। কারণ মানুষের শরীর সেরা ফার্মেসি আর মন সেরা ডাক্তার। 
লম্বা দম, নো টেনশন!
টেনশনে অনেকের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও কাজ-কর্ম ব্যহত হয়। এই সমস্যা দূর করতে অব্যর্থ সমাধান ব্রিদিং এক্সারসাইজ; অর্থাৎ বুক ভরে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ। নিয়মিত ব্রিদিং এক্সারসাইজ করলে আপনার জীবনধারা বদলে যাবে। সকালে নাশতার টেবিলে যাওয়ার আগে মাত্র ১৫ মিনিটের এই ব্যয়াম দেহ-মনকে সতেজ করবে। দিন শুরুর আগে শরীরটাকে চাঙ্গা করা আরকি! এরপর রাতে খাওয়ার আগে একই কায়দায় মিনিট দশেক ব্যায়ামটা করলে ঘুম হবে আরামদায়ক। জেনে নিন, কিভাবে কী করতে হবে ।

* মেঝেতে পা ভাঁজ করে, মেরুদণ্ড সোজা রেখে, মাথা উঁচু করে বসুন। দুই হাত হাঁটুর উপর রেখে মুখ বন্ধ করে নাক দিয়ে খুব ধীরে বুকভরে শ্বাস নিন। শুরুতেই পেট ফুলিয়ে নিন, যেন বাতাসে ভরে ফুলে ওঠার জন্য ফুসফুস যথেষ্ট জায়গা পায়। এরপর না থেমেই বুক ফুলিয়ে বাতাস টানুন। কয়েক সেকেন্ড শ্বাস ধরে রেখে মুখ দিয়ে ঝট করে শ্বাস ছাড়ুন।

* মূলত নাক দিয়েই শ্বাস নিবেন। কারণ নাসারন্ধ্রের পশম বাতাসের ধুলাবালু ছেঁকে রাখে। আর দীর্ঘপথে যাওয়ার সময় বাইরের বাতাসটা শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে সমন্বিত হয়। ফলে ফুসফুসে সংক্রামণের আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়।

* পূর্ণবয়ষ্ক মানুষের ফুসফুসের দুই পাশের অংশে প্রায় ৭০ কোটি অ্যালভিউলা বা বায়ুকুঠুরি থাকে। এখান থেকেই শরীরের রক্ত বাতাসের অক্সিজেন গ্রহণ করে পরিশোধিত হয় ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। 

* অ্যালভিউলা-এর অনেকগুলোই সুপ্ত থাকে, কাজ করে না। ফলে শরীর যথেষ্ট অক্সিজেন পায় না। এজন্য ব্রিদিং এক্সারসাইজ দরকার। এতে সবগুলো অ্যালভিউলা সক্রিয় হয় এবং শরীর প্রচুর অক্সিজেন পায়। 

* ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে হবে পরিষ্কার বাতাসে, ধুলাবালু মুক্ত পরিবেশে।


রাজিব আহমেদ : পেশা পরামর্শক ও আত্মউন্নয়ন বিষয়ক বইয়ের লেখক। মুঠোফোন ০১৮১৭-১৮০১৮৮